দাবাগুরু কাজী মোতাহার হোসেন

দাবাগুরু কাজী মোতাহার হোসেন

Avatar of whatagoodday
|

কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই, তৎকালীন নদীয়া জেলার ভালুকা (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে। পৈতৃক নিবাস রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। মোতাহার হোসেনের পূর্বপুরুষ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দিল্লি-দরবারে ধর্মীয় উপদেষ্টা ও বিচারক (কাজী) পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই সূত্রেই মোতাহার হোসেন ‘কাজী’ পদবী লাভ করেন। পিতা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ ও মাতা তসিরুন্নেসার আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। বাবা কাজী গওহরউদ্দীনের সরকারি চাকরি ছিল, তাঁর সংসারে অসচ্ছলতা ছিল নিত্য সঙ্গী। বালক মোতাহারের পড়ার খরচ পুরোপুরি বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই বৃত্তি পেতেন বলে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। কখনো কখনো বৃত্তির টাকার সংসারে খরচ করে নিজের খরচ চালানোর জন্য টিউশনি বা দীর্ঘমেয়াদী বন্ধে (গ্রীষ্ম বা পূজার বন্ধে) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন তিনি। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেছেন, কিন্তু লেখাপড়া ছেড়ে দেননি।

কাজী মোতাহার হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুষ্টিয়াতেই। মেধাবী ছাত্র হিসাবে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৭ সালে নিম্ন প্রাইমারি ও ১৯০৯ সালে উচ্চ প্রাইমারি পাশ করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথমস্থান অর্জন করে মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তিলাভ করেন। ঢাকা কলেজে তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়াল্টার অ্যালেন জেনকিন্স, পদ্মভূষণ ভূপতি মোহন সেন, ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এমএ পাশ করেন। উল্লেখ্য, সেবছর কেউ প্রথম শ্রেণি পান নি। ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। যুগপৎভাবে, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল 'Design of Experiments'। তার ডক্টরাল থিসিসে তিনি 'Hussain's Chain Rule' নামক একটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেন। বস্তুত, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) তিনিই প্রথম স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ।

১৯২১ সালে ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর হিসেবে চাকরি শুরু করেন এবং একই বিভাগে ১৯২৩ সালে একজন সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। কাজী মোতাহার হোসেনের নিজ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে এম. এ. কোর্স চালু হয় এবং তিনি এই নতুন বিভাগে যোগ দেন। তিনি গণিত বিভাগেও ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পরিসংখ্যানে একজন রিডার ও ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পরিসংখ্যান বিভাগে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তিনি প্রথম পরিচালক। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের অগ্রগন্য ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেন একইসাথে একজন দাবা অনুরাগীও ছিলেন। তাঁর দাবাখেলার সঙ্গী ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সতীশচন্দ্র আড্ডী (সর্বভারতীয় চ্যাম্পিয়ন), কিষাণলালের মতো বিখ্যাত লোকেরা। ১৯২৫ সালে তিনি 'অল ইণ্ডিয়া চেজ ব্রিলিয়ান্সি' প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। কাজী মোতাহার হোসেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন। ফুটবল, টেনিস, হাই জাম্প, সাঁতার এবং ব্যাডমিন্টনেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল। ১৯৫১ সালে ঢাকায় লন টেনিস প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন হন।

ABC News

১৯৬১ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানে কাজী মোতাহার হোসেনের উদ্যোগেই সর্বপ্রথম ‘পূর্ব পাকিস্তান দাবা সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া সৈয়দ জাহিদ মানসুরের সাথে মিলে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অল পাকিস্তান দাবা ফেডারেশন’, তিনি হন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

১৯৪৭ সাল থেকে পুর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি দাবা চ্যাম্পিয়নশীপ শুরু হলে কাজী মোতাহার হোসেন হন সেই সময়ের চ্যাম্পিয়ন। ১৯৬১ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান দাবা সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হলে শুরু হয় অফিসিয়াল প্রতিযোগিতা। কাজী মোতাহার হোসেন চ্যাম্পিয়ন হন তখনও এবং এই ধারা অব্যাহত রাখেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত।

তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে কিউ এম হোসেন আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা। আজীবন জ্ঞানসাধক এই ব্যক্তি সমধিক পরিচিত ‘দাবাগুরু’ নামেও।

কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সুলেখক। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে 'সঞ্চায়ন' (১৯৩৭; প্রবন্ধ সংকলন), 'নজরুল কাব্য পরিচিতি' (১৯৫৫), 'সেই পথ লক্ষ্য করে' (১৯৫৮), 'সিম্পোজিয়াম' (১৯৬৫), 'গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস' (১৯৭০), 'আলোক বিজ্ঞান' (১৯৭৪), 'নির্বাচিত প্রবন্ধ' (১৯৭৬), 'প্লেটোর সিম্পোজিয়াম' (অনুবাদ; ১৯৬৫) অন্যতম।

বার্ধক্যে এসে তাঁর সবচেয়ে বড় সঙ্গী হয়ে ওঠে দাবার বোর্ড। কানে কিছুটা কম শুনতে পেতেন বলে মানুষের সাথে খুব একটা কথা বলার, গল্প বা আড্ডার সুযোগ হতো না তাঁর। তাই যেখানেই দাবাড়ু পেতেন দাবার বোর্ড সাজিয়ে বসে পড়তেন। এই মহান ঋষিতুল্য মানুষটি ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর মারা যান, দিনটা ছিল ঈদের দিন। 

প্রাসঙ্গিকঃ

কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে যত কথা লেখা হয়েছে, তাতে তাঁর আত্মভোলা চরিত্র আর দাবা খেলার নেশার কথাই উঠে এসেছে বেশি। কেউ কেউ সেটা শুধরে নিয়ে বলেছেন, তিনি আত্মভোলা ছিলেন না, ছিলেন আত্মমগ্ন এক মানুষ।

কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে অনেক গল্প-কথার ভিড়ে এ কথা হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছেন যে ১৯৬১ সালের মে মাসে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনজন বিশিষ্ট মানুষ গিয়েছিলেন সিলেটে। তাঁরা হলেন কাজী মোতাহার হোসেন, গোবিন্দচন্দ্র দেব (জিসি দেব) ও বেগম সুফিয়া কামাল। মোতাহার হোসেনের দাবার নেশার কথা সেখানেও সবাই জানতেন। দাবার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলে তখনকার তরুণ সালেহ চৌধুরীর ওপর পড়েছিল কাজী সাহেবের দেখভালের ভার। রশিদ মঞ্জিলে হয়েছিল তাঁর থাকার ব্যবস্থা। বাসায় পৌঁছেই সালেহ চৌধুরীকে ডেকে কাজী সাহেব বললেন, ‘শুনেছি, সিলেটে ভালো দাবা খেলোয়াড় আছেন। এখনই কয়েকজন দাবা খেলোয়াড়কে নিয়ে আসেন।’

সালেহ চৌধুরী নিয়ে এলেন আজিজুর রহমান, ফণী বাবু আর আবদুল করিম চৌধুরীকে। কাজী সাহেব খুব ভালো দাবা খেলেন। সংগত কারণে কেউই তাঁর সঙ্গে দাবা খেলায় উৎসাহী ছিলেন না। সালেহ চৌধুরীরা নিজেরা সলা করে ঠিক করলেন, চারজন মিলেই কাজী সাহেবের বিরুদ্ধে খেলবেন তাঁরা। কাজী সাহেব কানে কম শোনেন, তাই দাবার চাল দেওয়ার সময় ফিসফিস আলোচনা করে নেওয়া যাবে। সেভাবেই প্রথম দান হলো এবং যা হওয়ার তা–ই হলো, কাজী সাহেব হারলেন। খেলায় জিতে চারজন তো দারুণ খুশি। কিন্তু কাজী সাহেবের কথা শুনে তাঁদের আক্কেলগুড়ুম! স্বভাসুলভ ধীরকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বুড়ো তো হারল, সবাই খুশি তো? ভেবেছেন, বুড়ো কানে শোনে না, কিছুই বুঝবে না! তবে বুড়োর চোখ তো আছে, ঠোঁট নড়া তো দেখতে পায়।’

খুবই লজ্জা পেলেন তাঁরা। এরপর একা একা যে কটা দান খেললেন, জিতলেন কাজী মোতাহার হোসেন।

(তথ্য উৎস: উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো'তে প্রকাশিত এই লেখাটি  ও অন্যান্য ব্যক্তিগত খোঁজ। 

দাবা নিয়ে নিয়মিত লেখা+ছবি পেতে অনুসরণ করতে এখানে ক্লিক করুন!)