
দাবা কিংবদন্তী হোসে রাউল কাপাব্লাংকা
কেউ কখনো চিরতরে গুরুত্বহীন হয়ে যায় না। জীবন যুদ্ধে জয়-পরাজয় যাই আসুক না কেন নায়ক সবসময় নায়কের ভুমিকায়ই থাকে। প্রতিটি মানুষই তার নিজস্ব মঞ্চে মূল অভিনেতা। কিংবদন্তী দাবারু হোসে রাউল কাপাব্লাংকার জীবন আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
১৯২৭ সালে ফরাসী দাবারু আলেক্সান্ডার আলেখিনের কাছে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব হারানোর আগ পর্যন্ত দাবা জগতে কাপাব্লাংকার মর্যাদা কেমন ছিল জানেন? ১৯০৮ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত বিশ্বের সকল দাবারুদের সর্বোচ্চ যোগ্যতা মাপা হত তারা কখনো একবার হলেও কাপাব্লাংকাকে হারাতে পেরেছে কিনা তা দেখে। আর যদি পেরেও থাকে তাহলে তা একবারের বেশী ছিল কিনা। অবিশ্বাস্য হল কাপাব্লাংকা সারা জীবনে যত দাবারুর সাথে খেলেছেন তাদের প্রায় অর্ধেকই তাকে একবারের বেশী দাবা বোর্ডে হারাতে পারেনি। ১৯২১ সালে কাপাব্লাংকা যখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় তখন প্রতিপক্ষে ছিলেন টানা ২৭ বছর ধরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মান কিংবদন্তী ড. ইম্যানুয়েল লাস্কর। যদিও লাস্কর বয়স্ক ছিলেন, তাঁর দুর্ভাগ্য হল টুর্নামেন্ট ফাইনালের ২৪ টি খেলার একটিতেও তিনি কাপাব্লাংকাকে হারাতে পারেননি!
কিন্তু ১৯২১ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার পর পরই কাপাব্লাংকার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে যা তাকে দাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ১৯২২-১৯২৬ সাল পর্যন্ত সময় তিনি যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেন তা হল বিয়ে, সন্তান, বাবা-মায়ের মৃত্যু, দাম্পত্য কলহ, পরিবারে গুরুত্বহীন অবস্থান ও মানসিকভাবে অসহনীয় হয়ে পরা। ইতমধ্যে ১৯২৪ সালে একবার তিনি দাবা থেকে সরে আসার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। যাহোক ১৯২৭ সালে আলেখিন সহজেই কাপাব্লাংকার কাছ থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খেতাব ছিনিয়ে নেন। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই সব উলট পালট হয়ে যায়। সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সবকিছু হারিয়ে বলা চলে কাপাব্লাংকা নিঃস্ব ও একাকী হয়ে পরেন।
১৯৩৪ সাল পর্যন্ত নামকরা কোন ইভেন্টের দাবা বোর্ডে আর দেখা যায়নি এই কিংবদন্তীকে। তারপরই হঠাৎ ভিন্ন কিছু ঘটে! Olga Clark নামে এক নারীর সাথে নিউইয়র্কে প্রথম সাক্ষাতেই প্রেমে পরেন কাপাব্লাংকা। Olga নিজেকে স্বঘোষিত রাজকন্যা দাবি করতেন। পরে তারা বিয়ে করেন। কিন্তু সম্পর্কের সম্মান হিসেবে কাপাব্লাংকা তার প্রেমিকাকে দাবায় নিজের হারানো মুকুট ফিরে পাবার প্রতিশ্রুতি দেন। দাবা বোর্ডে ফিরে আসেন কাপাব্লাংকা। কিন্তু বিষয়টা ততদিনে আর অত সহজ ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবার দুনিয়ায় ছড়ি ঘুরাতে শুরু করেছে। সোভিয়েত চেস ইঞ্জিন মিখাইল বটনিক যুগের সূচনালগ্ন চলছে তখন। দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আলেখিন আর ম্যাক্স ওয়ের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মাতছে বিশ্ব। হোসে রাউল কাপাব্লাংকা যেন একটি হারিয়ে যাওয়া নাম। ১৯৩৪-৩৫ সালে হ্যাস্টিংসে এক টুর্নামেন্ট দিয়ে শুরু করেন কাপাব্লাংকা। কিন্তু এভাবে ফিরেই কি আর ভাল করা যায়? টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হন ম্যাক্স ওয়ে। তাঁর থেকে থেকে এক পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে টুর্নামেন্টে চতুর্থ হন কাপাব্লাংকা। পরের বছর ১৯৩৫ সালের মস্কো টুর্নামেন্টেও একই ফল নিয়ে শেষ করেন তিনি। টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন মিখাইল বটনিক থেকে এক পয়েন্ট কম নিয়ে চতুর্থ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। সবাই ভাবতে শুরু করে "চ্যাম্পিয়ন কাপাব্লাংকা" নামটির গুরুত্ব বুঝি ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু এরপরই সব পরিবর্তন হতে থাকে। ঐবছরই মার্গেটে এক টুর্নামেন্টে রানার আপ হন কাপাব্লাংকা।
কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়া একসময় যার নিয়মিত অভ্যাস ছিল তাকে কি আর দ্বিতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে মানায়? কাপাব্লাংকা খুব দ্রুত তার ক্রাশিং ধারায় ফিরে আসেন। ১৯৩৬ সালে মার্গেটে এক আন্তর্জাতিক চেস ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। টুর্নামেন্ট জুড়ে ১৯ টি খেলার একটিতেও হারেননি। সহসা সকল দৃষ্টি যেন কাপাব্লাংকার উপর পরে। জেনুইন কাপাব্লাংকা ইজ কাম ব্যাক!!! ১৯৩৫ সালে যেই মস্কোতে তাকে চতুর্থ অবস্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলেন সেই মস্কোতেই পরের বছর বটনিক, লাস্কর, লিলিয়েন্থাল, এবং সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন টিমের বাছাই করা খেলোয়াড়দের একচেটিয়া নাস্তানাবুদ করে চ্যাম্পিয়ন হন কাপাব্লাংকা। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে একটি খেলায়ও কেউ তাকে হারাতে পারেনি। ১৯৩৬ সালের মস্কোর এই টুর্নামেন্টটি হচ্ছে সেই টুর্নামেন্ট যেখানে সমগ্র সোভিয়েত দাবা সম্রাজ্য ইতিহাসে প্রথম একক কোন কিংবদন্তীর কাছে ধোলাই খেয়ে খেয়ে পরাজিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে ববি ফিসারের আগ পর্যন্ত আর কেউ সোভিয়েত দাবারুদের ধরাশায়ী করতে পারেনি।
কিন্তু কাপাব্লাংকা তার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য ছন্দটি দেখান ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত দাবা টুর্নামেন্টে। এই টুর্নামেন্টে সাবেক, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মিলে ৫ জন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অংশ নেয়। তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণ তৈরি করে আলেখিন বনাম কাপাব্লাংকার ম্যাচ! আলেখিনের কাছে ১৯২৭ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গৌরব হারানোর পর আর কখনো তাদের দাবা বোর্ডে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা যায়নি। কাপাব্লাংকা অনেক চেষ্টা করেও আলেখিনের সাথে পুনরায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাচের আয়োজন করতে পারেননি। ধারণা করা হয় এর ফলেই মূলত কাপাব্লাংকার জীবনে হতাশা নেমে এসেছিল।
গুটি গুটি চালে এগিয়ে যায় কাপাব্লাংক আর আলেখিনের খেলা। হঠাৎ আক্রমনে যায় আলেখিন। চিন্তায় ভাজ পরে বয়স্ক কাপাব্লাংকার কপালে। ক্রমাগত আক্রমনের মুখে টিকে থাকতে গিয়ে কাপাব্লাংকাকে দুটো নৌকোই খোয়া দিতে হয় আলেখিনের এক ঘোড়া ও হাতির বিনিময়ে। দু'চাল পর উভয়েরই মন্ত্রী বিদায় হয়। আলেখিনের বোর্ডে তখনও দুটো নৌকো। আর কাপাব্লাংকার শুধু হাতি ঘোড়া। আলেখিন নিশ্চিত এগিয়ে! কিন্তু এর পরই খেলায় মোড় শুরু হয়। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দাবারু কে তা নিয়ে ফিসার, কাপাব্লাংকা কিংবা মরফির মধ্যে বিতর্ক থাকলেও সবকালের শ্রেষ্ঠ এন্ডগেইম প্লেয়ার (শেষ খেলায় উস্তাদ) কে তা নিয়ে কাপাব্লাংকার বিপক্ষে কেউ কখনো তর্কে যাবে না। কাপাব্লাংকা ধীর মাথায় তার সৈন্যগুলো সাজাতে শুরু করেন। এমনভাবে তিনি গুটিগুলোর অবস্থান তৈরি করেন যেন মনে হয় দাবা বোর্ডে একটি মরুভূমি তৈরি হয়েছে। আর সেই মরুভূমির বালিতে আলেখিনের নৌকোদুটি যেন অচল অসহায়ের মত আটকা পরে আছে। জীবনের শেষ সাক্ষাতে পরাস্ত হয় আলেখিন! বরাবরের মত টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হন কাপাব্লাংকা দ্য গ্রেট অব দ্য গ্রেটস!
গত শতাব্দীতে যে চারটি টুর্নামেন্টকে দাবার ইতিহাসে সর্বকালের শক্তিশালী টুর্নামেন্ট বলা হয় সেগুলো হল- ১৯১১ সালের সান সেবাস্তিয়ান, ১৯৩৭ সালের নটিংহাম, ১৯৫৩ সালে জুরিখ এবং ১৯৭০ সালের পালমা দে মালোরকা ইন্টারজোনাল চেস টুর্নামেন্ট। কাপাব্লাংলা এই চারটি টুর্নামেন্টের দুটিতে অংশ নেবার সুযোগ পান এবং দুটিতেই চ্যাম্পিয়ন হন। প্রথমবার ক্যারিয়ারের একদম শুরুতে এবং আরেকবার জীবন থেকে ছিটকে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসার পর অর্থাৎ ক্যারিয়ারের একদম শেষে।
কারো সময় কখনো ফুরিয়ে যায় না। সময়কে ফিরিয়ে আনতে দরকার অদম্য ইচ্ছা আর সাধনা। একটা ছোট্ট ঘটনা, একটু সামান্য পরিচর্যা, একটু ফিরে তাকানো জীবনকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিতে পারে। কিউবান দাবা কিংবদন্তী হোসে রাউল কাপাব্লাংকা তার অনন্য দৃষ্টান্ত!
📑 ফেসবুকে অনুসরণ করুন : দাবাপাঠ
📑 গ্রুপে যুক্ত হতে : দাবাপাঠক