বাংলাদেশের দাবার ইতিহাস ও ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা
Bangladesh Chess History

বাংলাদেশের দাবার ইতিহাস ও ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা

Avatar of Nayemhaque22
| 1

বাংলাদেশে দাবা একটি জনপ্রিয় এবং সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের খেলা, যার শিকড় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন চতুরঙ্গ খেলার সাথে জড়িত। ষষ্ঠ শতাব্দীতে উদ্ভূত চতুরঙ্গ পারস্য এবং আরব বিশ্বের মাধ্যমে আধুনিক দাবায় রূপান্তরিত হয়, এবং গঙ্গা সমভূমির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশীদার। তবে, বাংলাদেশে আধুনিক দাবার সংগঠিত বিকাশ মূলত বিংশ শতাব্দীতে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরে ত্বরান্বিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এই খেলা উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বর্তমানে দাবা সকল  শ্রেণির মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের ভূখণ্ড যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের অংশ ছিল, তখন দাবা প্রধানত উচ্চবিত্ত এবং অভিজাত শ্রেণির মধ্যে খেলা হতো। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরে ছোট ছোট দাবা ক্লাব গড়ে উঠেছিল, যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এই খেলায় অংশ নিতেন। তবে, এই সময়ে দাবার কোনো আনুষ্ঠানিক সংগঠন বা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা ছিল না।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভাজনের পর বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) দাবার ক্ষেত্রে কিছুটা সংগঠিত রূপ পেতে শুরু করে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও পরিসংখ্যানের অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন পূর্ব পাকিস্তান দাবা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল এই অঞ্চলে দাবার প্রথম আনুষ্ঠানিক সংগঠন। তিনি, যিনি “দাবা গুরু” নামে পরিচিত, দাবার প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অনানুষ্ঠানিক দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে আধিপত্য বিস্তার করেন। ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান দাবা সংঘ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আনুষ্ঠানিক পূর্ব পাকিস্তান দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হয়, যেখানে ড. হোসেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত জয়ী হন। এই চ্যাম্পিয়নশিপগুলো পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিযোগিতামূলক দাবা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে কাজী মুহাম্মদ শাকুর ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই শিরোপা ধরে রাখেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দাবা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। যেখানে একসময় এই খেলা উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, স্বাধীনতার পর স্কুল, কলেজ এবং স্থানীয় ক্লাবগুলোর মাধ্যমে এটি সকল শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন (BCF) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দাবার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। BCF ১৯৭৯ সালে ফিডে (বিশ্ব দাবা ফেডারেশন)-এর আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ লাভ করে, যা বাংলাদেশের দাবাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যায়।

BCF বিভিন্ন স্তরের খেলোয়াড়দের জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজন করে, যার মধ্যে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ (পুরুষ ও মহিলা), জুনিয়র, সাব-জুনিয়র এবং আন্তর্জাতিক ইভেন্ট উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৪ সাল থেকে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রিমিয়ার বিভাগ (২০১১ থেকে) এবং ফার্স্ট ডিভিশন (১৯৭৭ থেকে) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ড. কাজী মোতাহার হোসেন বাংলাদেশে দাবার ইতিহাসে একজন পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধুমাত্র একজন দক্ষ খেলোয়াড়ই ছিলেন না, বরং দাবার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মূল স্থপতি ছিলেন। কিছু সূত্র অনুসারে, তিনি অল ইন্ডিয়া দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে একাধিকবার বিজয়ী হন এবং ১৯২৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দাবা জগতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি অল পাকিস্তান ন্যাশনাল দাবা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, তিনি বাংলাদেশ দাবা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন (BCF) হিসেবে পুনর্গঠিত হয়। তিনি BCF-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ড. হোসেনের অবদান শুধুমাত্র সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। একজন পরিসংখ্যানবিদ এবং অধ্যাপক হিসেবে, তিনি তার বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা দাবার কৌশলে প্রয়োগ করেন এবং এই খেলাকে জনপ্রিয় করার জন্য তার প্রজন্মের মধ্যে প্রচার করেন। তার অনেক শিষ্য পরবর্তীতে দাবায় সফলতা অর্জন করেন। তার স্মরণে BCF ১৯৮৫ সাল থেকে ড. কাজী মোতাহার হোসেন আন্তর্জাতিক মাস্টার্স দাবা টুর্নামেন্ট আয়োজন করে আসছে। তার বহুমুখী প্রতিভার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে।

বাংলাদেশে দাবা তার প্রাচীন শিকড় থেকে আধুনিক জনপ্রিয় খেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। একসময় উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এই খেলা এখন স্কুল, ক্লাব এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মাধ্যমে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। ড. কাজী মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দাবা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ভিত্তি পেয়েছে। ভবিষ্যতে আরও তরুণ প্রতিভার উদ্ভব এবং আন্তর্জাতিক সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের দাবা বিশ্ব মানচিত্রে আরও উজ্জ্বল হবে বলে আশা করা যায়।